লেখাটি লিখছি ৫ই অক্টোবর, এই বছর দিনটি বিজয়া দশমীর। শহরে বিশাল আয়োজনে ভাসান চলছে। আরো পাঁচটি বাঙালি অধ্যুষিত জায়গার মতোই আসাম রাজ্যের এই শহরটিতেও দিনটি প্রতি বারের মতো এবারেও সাড়ম্বরে উদযাপন করা হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তার ছবি, আবেগস্ফীত বার্তায় ভরে উঠেছে। আর হবেই বা না কেন। মোটের ওপর ধর্মভীরু এই শহরের জনসংখ্যা তো আর কম নয়। আবার সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতির দিক থেকেও এই শহরের মানুষ পিছিয়ে নয়। এই শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব। প্রচলিত বিশ্বাস মতে ঘরের মেয়ে বছরের এই সময়ে ঘরে ফিরে আসে। দশমীর দিনে সেই মেয়ে পতিগ্রহে পতিগৃহে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই দিনটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের বিশেষ আবেগ থাকে। চিরাচরিত এই আবেগের গণ্ডীর বাইরে গিয়ে ভাবলে দেখা যায় যে মাটির প্রতিমা তৈরি করে চারদিন সাড়ম্ভরে পুজো করে বিসর্জন, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই জ্ঞানের অভাবে গড়ে ওঠা প্রাচীন বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসকে তুষ্ট করার আয়োজন মাত্র। তবে লক্ষণীয় যে এই আয়োজনের সঙ্গে ‘ঘরের মেয়ে’, ‘গৃহ’, ‘শুভ শক্তি’র মতো শব্দগুলো ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে।
এই তো গেল একটা দিক। এই দিকে 'ঘরের মেয়ে', 'ঘর', 'অশুভশক্তির ওপর শুভশক্তির জয়’ আছে। আছে আত্মীয়তার মাধুর্য। আছে বুকভরা আবেগ। এবার দেখা যাক অন্য একটি দিকে। এই দিকটি আগেরটার মতো এক পক্ষের মাত্র ক’দিনের সাড়ম্বর স্থায়ীত্ব নিয়ে থাকে না। এর স্থায়ীত্ব কোনো অলৌকিক শক্তিকে কল্পনা করে নয়। এই স্থায়িত্ব বছরজুড়ে, এর উপস্থিতি অনাড়ম্বর সাধারণ মানুষের জীবনে, মননে। এদিকে আমরা দেখি একদল লোভী মানুষ, তাদের অঙ্গুলহেলনে অঙ্গুলিহেলনে সরকার ও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের কর্তাদের সামনে ফি বছর মানুষের নিরুপায় অবস্থা। আমরা দেখি কিভাবে এদের পায়ে দলে দলে মহিলারা পড়ে নিজেদের ঘর রক্ষার জন্য ভিক্ষা করে, কোলের শিশুকে এগিয়ে দিয়েও এই লোভীদের পথরোধ হয় না। না, এই দৃশ্য খুব বেশি দূরের নয়, সময় ও ভৌগোলিক, কোনোদিকেই। আজ যে শহরে শারদীয় দুর্গোৎসব নিয়ে এতো জাঁকজমক, তার থেকে মাইল পনেরোর দূরত্বের মধ্যেই আছে ডলু চা বাগান। সবুজে ঘেরা, হ্রদের ধারে পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলা ছবির মতো সুন্দর একটি বাগান। ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল এই বাগানের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। গত মে মাসে শ্রমিকদের প্রবল আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এই চা বাগানে রাজ্য সরকার বিমানবন্দর বানানোর নামে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল। যদিও কিছুদিন পরেই জানা যায় এই ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের কিছুই জানা ছিল না, অনুমোদন দেওয়া তো দূরের কথা। কথা হল সেদিন বিশাল পুলিশ বাহিনীর সামনে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাও নারী ছিলেন, এই বাগানটিই বংশপরম্পরায় এঁদের ঘর ছিল। কল্পকথার কৈলাশ পর্বত না হলেও কয়েক পুরুষ ধরে নিজেদের ঘাম, রক্তের বিনিময়ে তৈরী সেই ঘরের মাহাত্ম্যই বা কম কিসে।
আজকে ‘ঘরের মেয়ে’ ঘর শূন্য করে চলে যাচ্ছেন বলে যারা পাতার পর পাতা লিখছেন, সেদিন যে কেন অবাক নিস্তব্ধতায় তাঁরা এই রক্ত মাংসের মেয়েদের ঘরছাড়া করাকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরাই জানেন।
শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোড়ে জোরে মাটির তৈরি প্রতিমা 'ঘরের মেয়ে'র স্থান পেয়ে যায় আর এই রক্তমাংসের মানুষগুলোর কপালে জোটে একরাশ বঞ্চনা ও অবহেলা।
এই পরিচিত্র কিন্তু শুধু এই শারদীয় দুর্গোৎসব বা দেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাসকারী মানুষের মধ্যেই সীমিত তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাট, কেরালা থেকে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, মানুষ ভিন্ন, আরাধ্য দেব-দেবী ভিন্ন কিন্তু কল্পকথার সেই আরাধ্য দেব-দেবীকে নিয়ে আবেগের যেমন শেষ হয় না, তেমনি রক্তমাংসের অসহায় মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনার প্রতি নির্বিকার, বীতস্পৃহ মনোভাবেরও বদল হয় না। কোথাও বাঁধ, কোথাও মূর্তি, কোথাও খনি আবার কোথাও রেলপথের নামে এভাবেই শতসহস্র উমা, পার্বতীরা তাদের কৈলাশ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। পুজোর মণ্ডপে দেবী দুর্গার হাতে অসুরের মৃত্যু আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্য। পৌরাণিক কাহিনি মতে দেবী দুর্গা এখানে একাধারে নারীশক্তি ও শুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে অসুর অশুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। তবে ধর্মের ইতিহাস অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে। উজ্জ্বল বর্ণের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতা দুর্গা এখানে আক্রমণকারী, রণকৌশলী আর্য ও কৃষ্ণবর্ণের অসুর এখানে আদি ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আজকের সময়ের নিরিখে বিজয়া দশমীতে সেই পৌরাণিক কাহিনিকে পাথেয় করে 'অশুভশক্তির' ওপর 'শুভশক্তির' জয় উদযাপন করা হয়। অথচ তথাকথিত এই দেবীপক্ষ নিয়ে আমাদের বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে অনুষ্ঠানাদির বাইরে গিয়ে যদি দেখি, সেখানে কিন্তু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ধর্মীয় ইতিহাসের বারংবার পুনরাবৃত্তি।
সেখানে আজও ভূমিপুত্র, অনুন্নত, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা সমাজে ক্ষমতাবানদের আগ্রাসন লোভের কাছে এভাবেই পরাভুত হন।
তাদের কথা শোনার, তাদের দুঃখ বোঝার ইচ্ছা কারোর নেই। জায়গা বদলায়, সময় বদলায়, দৃশ্য বদলায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে এই অবিচারের কি কোনো প্রতিবাদ হয় না? সাধারণ মানুষ বা অন্ততঃপক্ষে যারা দিনের পর দিন ধরে এভাবে অত্যাচারীত হয়ে আসছেন তারা কেন প্রতিবাদ করেন না। দেশে থানা আছে, আদালত আছে। প্রশ্নের উত্তরটা হল সমসাময়িক সভ্যতা থেকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকা এই মানুষদের প্রতিবাদের 'অস্ত্র' বা 'রণকৌশল' সবই সেকেলে।
তাদের কাছে থানা, আদালত কোনো কিছুই বিচার, ভরসা দিতে পারে না। সংবাদমাধ্যমের কাছে এরা খুব বেশি মাত্রায় অচ্ছুৎ।
যদিও বা কোনোদিন, কোনোভাবে এই প্রান্তিকরা একান্ত নিরুপায় হয়ে তাদের প্রতি হয়ে আসা এই অবিচারের প্রতিবাদ করেন তখন তাদের অবস্থা হয় অসুরের মতোই। মরতে তো তাদের হয়ই, উপরন্তু সমাজের সামনে সভ্যতার নিখাদ শত্রুর পরিচয়ও পেতে হয়। সংবাদমাধ্যম যেমন তাদের রাতারাতি জঙ্গি বানিয়ে দেয়, সরকার মাওবাদী তকমা দিয়ে দেয়। ধর্মীয় ইতিহাসের ভূমিপুত্র সেই অসুর প্রচারের ঠেলায় পৌরাণিক কাহিনীর সভ্যতা বিরোধী, নারীর অপমানকারী অসুর হয়ে যায়। আর যারা চরম স্বার্থপরতার প্রমাণ দিয়ে এই চরম অমানবিক কাজটি করে এরাই হয়ে ওঠে সমাজের কাছে সভ্যতার ধ্বজা বহনকারী অগ্রদূত। জ্ঞান ও চেতনার অভাবে আমরা, সাধারণ মানুষ এই অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের ওপর তাদের এই জয়কেই সভ্যতার জয় বলে মেনে নিই, সাড়ম্বরে উদযাপন করে আত্মতুষ্টি লাভ করি।
রাহুল রায়, শিলচর।