সমস্ত লেখাগুলি

ধ্বংসের বোপীত বীজ ও শেষের অপেক্ষা -
রাহুল রায়
Nov. 26, 2024 | ভ্রমণ | views:900 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডস্থিত কেদারনাথ নিয়ে একটি লেখা পড়া হচ্ছিল। কেদারনাথ মন্দিরটি নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এতে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করছিলেন। অবশ্য তাতে মন্দির কর্তৃপক্ষ কোনও সাড়া দেয়নি যেমন সে রাজ্যের সরকার সাড়া দেয়নি কেদারনাথ মন্দিরের সামনে ছোটোখাটো একটি জনপদ গড়ে তোলার বিরুদ্ধে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের আবেদনেও। কারণ একটাই, টাকা। গতবছর কেদারনাথ মন্দিরে রেকর্ড ভাঙা ভিড় হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটকরা আসছেন, সঙ্গে আনছেন খরচ করার জন্য টাকা। সেই টাকা থেকে রাজ্যের অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু কথা হল আজকে না হয় দুধ ভাতের পথ বের করা হল, কাল যদি এই মন্দিরটিই কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বলি হয়ে যায় তখন যে দুধ ভাত কি ফেন ভাতও কপালে জুটবে না। কেদারনাথের মতো মন্দির প্রাচীন ভারতের বিস্ময়কর স্থাপত্যের নিদর্শন। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে একে বিপর্যস্ত করে নেওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই সবার পক্ষে মুখ বুজে মেনে নেওয়াটা সম্ভব হয়নি।

প্রকৃতির নিয়মকে তোয়াক্কা না করলে চললে কি হয় প্রকৃতি উত্তরাখণ্ড রাজ্যেই কিছুদিন আগে তার একটি উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের চামোলী জেলার যোশীমঠ সম্পর্কিত ঘটনাক্রম জনমানসে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ হিমালয়ের ধ্বস সংক্রান্ত নানা দুঃসংবাদ সচেতন সব মানুষেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাহাড়বাসী সাধারণের জনজীবন যারপরনাই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যয় একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুদীর্ঘ কাল যাবৎ বিপথগামী যাপনের ফল। সুউচ্চ তরুশ্রেণী দ্বারা আচ্ছাদিত হিমালয়ের পর্বত গাত্র। বরফ গলা নির্মল জল প্রাকৃতিক নিয়মেই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ খুঁজে নেমে আসে তটভূমিতে। পুষ্ট করে নিম্নভূমির নদীর স্বাস্থ্যকে। ভঙ্গুর পাহাড়ের গায়ে অজস্র গাছ গাছালির শেকড়ের বাঁধন ভূমির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত পাহাড়ি গাছের কাঠ দিয়ে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করেন পাহাড়ি জনজাতির মানুষজন। তাদের তৈরী কাঠের বাড়ি যেমন পাহাড়ি শীত প্রতিরোধে সক্ষম, তেমনই ভার কম হওয়ার জন্য পাহাড়ের ঢালু ভঙ্গুর জমির ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভারও প্রযুক্ত হয় না। পাহাড়ের সহন ক্ষমতার মধ্যেই থাকে স্থানীয় গ্রামগুলি। গ্রামগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়ে যায় পাহাড়কে অক্ষুন্ন রেখেই। 


সমস্যা হয়েছে মানুষের কুশিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায়, সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু যে শিক্ষা মানুষের বোধশক্তি রহিত করে দেয় তাকে কুশিক্ষা ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। উত্তরাখণ্ডের মানুষ পড়াশোনা করতে বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে বিলাসবহুল জীবন, আধুনিক নির্মাণশৈলী দেখছেন, বাড়ি এসে নিজের জীবনে, বাড়িঘরে সেটার প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। বড় বড় বাড়ি, হোটেল অহরহ হচ্ছে। শত-শত গাড়ি টন টন কার্বন নিঃসরণ করে প্রতিদিন যাওয়া আসা করছে। পাহাড় একদিকে সবুজহীন হচ্ছে অন্যদিকে কার্বন একে গরম করে তুলছে। অবশ্য সব দোষ যে মানুষের তাও নয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিত্য নতুন নিয়ম করে পাহাড়,  জঙ্গল সাফ করে নানা রকম প্রকল্প হাতে নেওয়ার আইনতঃ ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কেদারনাথ মন্দিরের সামনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দিন ধ্যান করতেই পারেন, এতে অসুবিধা নেই, ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে থাকার অধিকার একজন ভারতীয় হিসাবে ওঁর আছে। ভারতের মতো দেশে সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে এতে মানুষের আবেগকে নিজের পাশে পাওয়াই যায় কিন্তু প্রকৃতির চিন্তাকে পাশে রেখে এনটিপিসির তপোবনের মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করলে প্রকৃতির কিন্তু তার রুদ্র রূপ নিতে পিছপা হবে না। আর সমস্যা হল এখানে ইডি, সিবিআই, পুলিশ, আদালত, আইটি সেল কেউই কিছু করতে পারবে না। রাজ্য সরকারেরও একই অবস্থা। পাহাড়ের মানুষ হয়েও এরা পাহাড় রক্ষার চিন্তা করছে না। পর্যটন ও রাজস্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা, জঙ্গল সাফ করে নগরায়ন হচ্ছে। রেলের জায়গা খালি করতে সাড়ম্বরে বুলডোজার চালিয়েছেন ভালো কথা, স্থানীয় মানুষের দাবী মেনে একই রকম ব্যবস্থা যদি পাহাড়ে সবুজ ফেরাতে করতেন তাহলে আজ অন্ততঃ এই দিন দেখতে হতো না। এতসবের মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের সামঞ্জস্য স্বাভাবিক ভাবেই নষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছেন না কেন। যোশীমঠের মানুষ করেছিলেন, মাসের পর মাস, বিশেষজ্ঞরা ১৯৭৬ সন থেকেই ততকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকার ও পরবর্তীতে উত্তরাখণ্ড সরকারকে সতর্ক করছেন, কেউ কর্ণপাত করেনি। তবে আজকাল আবার প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলতেও সমস্যা আছে। প্রকৃতি রক্ষার ব্যবস্থা না হোক, সরকারী নীতি রক্ষার্থে প্রতিবাদীদের বিদেশী রাষ্ট্রের টাকায় উন্নয়ন বিরোধী শহুরে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু পাকাপোক্ত করা হয়েছে।


পর্যটনের বিকাশের নামে বিপুল মানুষ বছরভর পাহাড়ে আসছেন। ফুলে ফেঁপে উঠছে ব্যবসা। মুনাফাপ্রেমী ওই এক শতাংশ মানুষের লোভী দৃষ্টি এসে পড়েছে পাহাড়, জঙ্গলে। পর্যটন বিস্তারের নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে পাহাড়ের ভঙ্গুর ঢালু গা বেয়ে গড়ে উঠছে চওড়া রাস্তা, সেতু কংক্রিটের মহোৎসব। সেই রাস্তার ওপর দিয়ে শ'য়ে শ'য়ে চলেছে পর্যটক ভর্তি গাড়ি। পর্যটকদের জন্য শত শত হোটেল খুলে রাখা মালিক, রিসর্ট মালিক, পর্যটকদের ব্যবহার করা গাড়ির মালিক হলেন ওই এক শতাংশ। এদের চাঁদায় নির্বাচন তরী পেরিয়ে আসা জনপ্রতিনিধিরা এদের বিরোধিতা না করে বরং নীরবে অংশীদারত্বের পথ নেন। তাঁরা বেমালুম ভুলে যান যে এই রাস্তার ভার, এই গাড়ির ভার, এত মানুষের ভার বহনে সক্ষম নয় হিমালয়ের ভঙ্গুর পাহাড়ের গা-গুলি। উপরন্তু রাস্তা, কংক্রিটের সেতু, হোটেল, রিসর্ট বানানোর সুপ্রশস্ত জায়গা পাওয়ার জন্য নির্বিচারে বলি হচ্ছে সুপ্রাচীন বৃক্ষ রাজি। শেকড়ের প্রাকৃতিক বাঁধন হারিয়ে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে কংক্রিটের ভারে নুয়ে পড়া পাহাড়ের ভূমি। ফল স্বরূপ ধ্বস ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। জীবনহানি, সম্পত্তিহানি, ওই বাকি নিরানব্বই শতাংশের। চকচকে পাহাড়ের চকচকে বিলাসবহুল শহরের প্রয়োজনে চাই ঝকঝকে আলো। আলোর প্রয়োজনে চাই বিদ্যুৎ। অতএব পাহাড়ি নদীর ওই দুর্দম গতিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ এর পরিকল্পনা। নদীর ওপর আবার কংক্রিট, বাঁধ নির্মাণ। বাঁধের জমে থাকা জলে পাহাড় গায়ের অসম ভার বৃদ্ধি। আবার পাহাড়ের ভারসাম্যের বিঘ্ন। প্রকৃতিকে শাসন করার এই ভ্রান্ত চর্চা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পৃথিবীর ধ্বংস প্রাপ্তি পর্যন্ত অবিরল গতিতে চলতেই থাকবে। আর ওই এক শতাংশ খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদে, মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার জায়গা। আরো একটি মুনাফার কারখানা। আমরা নিরানব্বই শতাংশ এই দুর্ভোগ নিয়ে অভিযোজন ঘটাতে ঘটাতে বেঁচে রয়েছি। উপযুক্ত চেতনার দ্বারা উপযুক্ত পথের সন্ধান করার প্রয়াসী না হলে বৃদ্ধি আর উন্নয়নের এই কালচক্র থেকে নিস্তার নেই আমাদের, ওই নিরানব্বই এর দলের লোকেদের। আজ যোশীমঠ, কাল উত্তরকাশী, নৈনিতাল একই ঘটনা ঘটতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই এই দুই জনবসতি নিয়ে সরকারকে গুরুতর সাবধানবার্তা দিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এরপর কি শেষ হয়ে যাবে এই ধ্বংস যজ্ঞ?  না, হবে না। মানুষ ধ্বংসের বীজ চারিদিকে বোপন করে রেখেছে। তা সে কেদারনাথ মন্দির প্রাঙ্গণই হোক বা বাংলার দার্জিলিং, কালিম্পং বা মেঘালয়ের শিলং। বোপিত বীজ অঙ্কুরিত হতে সময় কম বেশ লাগতেই পারে, কিন্তু হবে যে সেটা নিশ্চিত।

ইতিহাসের চাকা চলে আপন গতিতে -
রাহুল রায়
Nov. 25, 2024 | রাজনীতি | views:70 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আরও একটি ২৩শে জানুয়ারি দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রতিবারের মতো এবারও পাড়ায় পাড়ায় নেতাজী স্মরণ করা হবে। বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। নেতাজীর ছবি, তাঁর বাণী, তাঁর বীর গাঁথায় সাজানো ছবি, লেখা দিয়ে ভরে থাকবে সবক'টি অনুষ্ঠান মঞ্চ। সেদিন শাসক – বিরোধী - ছদ্ম বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সামাজিক মাধ্যমের প্রফাইলে নেতাজীর ছবি ও নামটি কিছু সময়ের জন্য জ্বলজ্বল করবে। এরপরেই শুরু হবে নেতাজীকে নিয়ে এদের তরজা। শাসক দল ১৯৪০ সনে কংগ্রেস থেকে তাঁর বহিষ্কার প্রশ্নে তাঁকে অকংগ্রেসী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে তুলে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। হয়তো এবারও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং নেতাজীর টুপি পড়ে এই মর্মে বক্ততা দেবেন। সংবাদমাধ্যম নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক রঙে নেতাজীকে রাঙানোর চেষ্টা করবে। যার অধিকাংশের রঙ আবার শাসক দলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এর বিপরীতে নেতাজীর অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী,  প্রগতিশীল মনন নিয়ে বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তবে এই সবই কিন্তু ওই একদিনের জন্যই। ২৩ জানুয়ারি যেতেই আবার সব যে যার জায়গায় চলে যাবে। পরের বছর আবার সেই একই চিত্র নতুন মোড়কে জনসমক্ষে পরিবেশিত হবে।

বলতে বাধা নেই এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাই করুক না কেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আপামর ভারতবাসী থেকে যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছেন সেটা তার আগে বা পরে কারোর কপালেই জুটেনি। হওয়ার কথাও নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনের সূযোগ যখন তার পাদদেশে অপেক্ষা করছিল তিনি তখন সেই সূযোগকে চরম অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেশ ও দেশের স্বাধীনতাকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও আপামর দেশবাসীর স্বাধীনতা। শুধু দেশ বা একটি ধর্মে বিশ্বাসী বা ভাষায় কথা বলা মানুষের স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। এখানে দেশের স্বাধীনতা ও দেশ ও দেশবাসী স্বাধীনতার পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া দরকার। উভয়ের মধ্যে শব্দের ব্যবধান বেশি না হলেও অর্থগত পার্থক্য বিরাট। প্রথমটিতে আমরা ফ্যাসিস্ট সুলভ চিন্তা পাই যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যই শেষ কথা, রাষ্ট্রই সর্বময়, মানুষ সেখানে রাষ্ট্রের নামে পরিচালকদের অনুগত প্রজাবৃন্দ, সেবক, তাদের প্রয়োজন, চাহিদা অনেকটাই গুরুত্বহীন। দ্বিতীয়টিতে পাই সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতার বার্তা। রাজনৈতিক ভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার মধ্যে থাকা একটি শিক্ষিত, রুচিশীল, প্রগতিশীল  অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন সমাজ। যেখানে প্রজার সর্বাঙ্গীন উন্নতিই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়। আজকের শাসকরা নেতাজীকে প্রথমটির সমর্থক হিসাবে তুলে ধরে নিজেদের পাশে আনতে চাইছেন। এজন্য অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে সব রকমের কূট কৌশল।  অথচ বাস্তবটা হল তিনি প্রথমটির অর্থাৎ অন্ধ জাতীয়তাবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এতটাই যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্যাসিস্ট সাহায্য নিয়েও হিটলারের বিরোধীতা করতে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বায় লাগাম পড়েনি। স্বাধীন ভারতে তিনি থাকলে আজকের রাজনীতি আর যাই হোক, বর্তমান অবস্থায় যে থাকতো না তা হলফ করে বলা যায়।


নেতাজীর জীবনে নিয়ে নিঃসন্দেহ  জনমানসে সবচেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক পর্ব সম্ভবত ১৯৪৫ সনের ১৮ আগষ্ট ও তার পরবর্তী অংশ। জাপানি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে ২১ আগষ্ট পৃথিবী জানতে পারে যে ১৮ আগষ্ট তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষের মৃত্যু হয়েছে। 


তবে এই খবরের মধ্যে এতোই ত্রুটি ও পরস্পর বিরোধীতা ছিল যে অচিরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ জাগতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু কেউই এই ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি। নেতাজী অনুরাগী দেশবাসীর কথা তো বলেই লাভ নেই৷ সময়ে সময়ে তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, মধ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে ধোঁয়াশাঘেরা করে রাখে। আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে নেতাজীর সমসাময়িক সব নেতাই প্রায় গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সরকারী নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ প্রায় কোনো রকম দৃঢ প্রমাণ ছাড়াই একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যুকে মেনে নেওয়া হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনানী শাহানুয়াজ খান কমিশন, বিচারক জি ডি খোসলা কমিটিও সরকারের বক্তব্যেই সায় দেয়৷ উল্লেখযোগ্য যে এরা কেইই তাইহোকুতে যাননি। অবশেষে ১৯৯৫ সনে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে  বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির নেতৃত্বে ঘটিত কমিশন তাইহোকু বা বর্তমান তাইওয়ান ঘুরে এসে জানায় যে যা তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে পরিষ্কার ১৮ আগষ্ট কোনো বিমান দুর্ঘটনা হয়নি এবং নেতাজী স্বাভাবিক ভাবেই তারপরেও বেঁচে ছিলেন। তখন দেশে  শাসনাধিষ্ঠিত কংগ্রেস সরকার। ২০০৬ সনে তারা মুখার্জী কমিশনের রিপোর্টকে সংসদে নাকচ করে দেয়। 


২০১৪ সনে দেশের শাসনে পরিবর্তন আসে। নেতাজী অনুরাগী সহ দেশবাসীর মনে একটি আশা জাগে যে এবার বোধহয় দেশনায়কের জীবনের ওপর থাকা রহস্যের আবরণ সরানো হবে। সরকারও এই ব্যাপারে তৎপর হয়ে নেতাজী সম্পর্কিত সব গোপন নথী জনগণের সামনে তুলে ধরবে বলে জানায়। কথামতো ফাইলগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলেও ধরা হয়। একই পথ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও৷ অর্থাৎ সরকারের কাছে এই মর্মে আজ আর কোনো নথী গোপন নেই৷ সমস্যা হল যা নথী বেরিয়ে আসল তাতে সেই রহস্যের ওপর থেকে এই মিলিমিটার আবরণও কিন্তু সরানো গেল না। নেতাজী ১৯৪৫ সনে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কি না রহস্যটি রহস্যই থেকে গেল। এমনকি কংগ্রেস সরকার বিচারক মনোজ কুমার মুখার্জির যে রিপোর্টটি নাকচ করে দেয় বর্তমান সরকার সেই রিপোর্টটি নিয়ে গত আট বছরে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিস্তম্ভটিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন কিন্তু তাঁর অধীনস্থ সরকার আজও দেশবাসীকে বলতে পারেনি যে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে আদ্য কতজন সেনানী ছিলেন, কতজনই বা শহীদ হোন, কেন আজও তাঁদের বীরত্বের ইতিহাসকে সেনাবাহিনীর ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পদে পদে ইতিহাস বদল করা হলেও এই ব্যাপারে সরকার জগন্নাথের ভূমিকাতেই স্বচ্ছন্দ। কিছুদিন আগে নেতাজীর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বাইক রেলীর অংশ হয়ে মৈরাঙ যাওয়া হয়েছিল। সেখানে জাপানী সেনানীদের সম্মানার্থে জাপান সরকার স্মৃতিসৌধ বানিয়ে রেখেছে, নাগাল্যান্ডের কোহিমা শহরে ব্রিটিশ সরকার একই কাজ করেছে।  অথচ এই দুই শহরেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের উদ্দেশ্যে কোনো সৌধ নেই৷ ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই করেনি। নাগাল্যাণ্ডের ফেক জেলার চেসেজু গ্রাম নেতাজীর স্মৃতি সগর্বে বহন করে চলেছে। ভারতের ভেতরে এই গ্রাম পর্যন্তই নেতাজী আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে আসতে পেরেছিলেন৷ সেখানে স্থানীয় মানুষ নেতাজী স্মৃতিতে একটি পাহাড়ের নামকরণ করেছিলেন। আজও প্রতিবছর শ্রদ্ধা, আবেগে এখন ঘটা করে নেতাজী স্মরণ করা হয়। তবে সরকারী সাহায্য, স্বীকৃতি ছাড়া সেখানের মানুষ কতদিন নেতাজী তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীর অমূল্য স্মৃতিচিহ্নগুলোকে কালের করাল থাবা থেকে রক্ষা করতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন।

নেতাজী সুভাষ জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস থেকে কোনোকালেই যোগ্য ব্যবহার পাননি। জওহরলাল নেহেরুর উত্তরসুরীরা একই পথ ধরে নেতাজী বিরোধিতা করে গেছেন। এতে অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু তা বলে নেতাজী ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদী বা অন্ধ জাতীয়তাবাদী ছিলেন বলে মেনে নেওয়া বা তার প্রচার করা নেতাজী তথা এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার নামান্তর হবে। সেরকমই কিছু বিশ্বাসঘাতক অহরহ প্রচার করে চলেন যে সমসাময়িক হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দেখানো পথেই নাকি নেতাজী সুভাষ ও মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানের মাটিতে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪০ সনের জুলাই মাসে হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের সঙ্গে নেতাজীর দেখা করার ঘটনাটির উল্লেখ তাঁরা এই মর্মে করে থাকেন। অথচ একই সময়ে নেতাজী মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহের সঙ্গেও দেখা করেন।  উভয়ের কাছে তাঁর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একই৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের সহযোগিতা চাওয়া। সেদিন উভয়ই নেতাজীকে ফিরিয়ে দেন। স্বরচিত The Indian Struggle পুস্তকে যার বিস্তারিত বিবরণী তিনি দিয়েছেন। নেতাজীর কাছে দেশের স্বাধীনতার থেকে বড় কোনো আদর্শ ছিল না, যার জন্য পরবর্তীতে তিনি কমিনিস্ট সোভিয়েত ও ফ্যাসিস্ট জার্মানীর কাছেও যান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে যুদ্ধে কমিনিস্ট রাশিয়া নেতাজীকে সমর্থন না করলেও তাঁর বিরুদ্ধাচারণও কোনোদিন করেনি। জার্মানি ও জাপান, দুই ফ্যাসিস্টবাদী দেশের সাহায্যই তিনি পেয়েছেন। এমনকি ইস্লামিক জাতীয়তাবাদী মুসলিম লিগ পরবর্তীতে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে আসলেও হিন্দু মহাসভা বা অন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো কিন্তু সুভাষ বিরোধীতার পথ থেকে কোনোদিন সরে আসেনি। আজ তাঁদের উত্তরসূরীরাই দেশের শাসনে এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এরা জওহরলাল নেহেরুর দৈন্য মানসিকতার সূযোগ নিয়ে নেতাজীকে নিজেদের শিবিরে আনতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতিহাসের শাস্তি বোধহয় একেই বলে, যাকে একদিন রিক্ত হস্তে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ তাঁকেই নিজেদের পাশে আনতে নিজেদেরই ইতিহাস ভূলে যেতে হচ্ছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হচ্ছে না । 

কেন এদেশে হিন্দুরা বিপদে? -
রাহুল রায়
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা প্রায়ই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি অভিযোগ পাই যে বিরোধী দল বা দলের নেতারা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশাচ্ছেন। এই দুইয়ের মিশ্রণে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। পরবর্তীতে অবশ্য এই নেতাদেরই মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় দেখা যায়। একাংশকে তো আবার এর মধ্যে সবগুলোতেই দেখা যায়, তাও আবার ভঙ্গিমা বদল করে প্রার্থনারত অবস্থায়। অন্যের ক্ষেত্রে যত নিন্দাই করুক না কেন নিজের বেলায় গর্হিত এই কাজকে তখন দিব্যি জনসংযোগ বলে এঁরা চালিয়ে দেন। যে যাই বলুন না কেন বাস্তবে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এদেশে আদি কাল থেকে চলে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতন থেকে শুরু করে মোঘল, ব্রিটিশ পর্ব পরিষ্কার বলে দেয় যে এখানে ধর্ম ও রাজনীতি ওতপ্রোত ভাবে একে ওপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই দুইয়ের কাণ্ডারীদের কাজ করার ধরণেও দারুণ মিল আছে। ধর্মের অভিভাবকরা যাদের আমরা পুরোহিত বলে চিনে থাকি, সাধারণ মানুষকে বশে রাখতে কখনো স্বর্গের লোভনীয় স্বপ্ন দেখান তো কখনও নরকের ভয় দেখান। আবার রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখা যায় মানুষকে পাশে রাখতে একই কাজ করেন। কখনও প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দেন তো কখনো মারাত্মক শাস্তির ভয় দেখান। অর্থাৎ লোভ আর ভয়ের অস্ত্রেই এই দুই পক্ষ নিজেদের মত করে ব্যবহার করে নিজেদের কাজ হাসিল করেন।


আজকের দিনের নিরিখে দেখতে গেলে 'আচ্ছে দিন', 'অমৃত কাল', ‘রামরাজ্য’কে সেদিক থেকে জনগণকে পাশে রাখতে দেখানো 'স্বর্গীয় লোভ' বলতে হবে। পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন স্বর্গ নামক জায়গাটিকে দেখেনি, অথচ পুরোহিতরা যুগ যুগ ধরে সেই কল্পনা থেকেও নাকি সুন্দর জায়গার টোপ দিয়েই যাচ্ছেন। ‘ধর্মের পথের’ পথিক হলে পুরোহিতদের আশীর্বাদে স্বর্গপ্রাপ্তি অবধারিত। স্বর্গের অবস্থান, আকার, অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসছে যে যেহেতু মৃত্যুর পরই সেখানে মানুষ যেতে পারে তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বর্গকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। অতীতে পুরোহিতরা ‘বিশেষ ক্ষমতাবলে’ সেই জায়গা সম্পর্কে জেনেছেন এবং সেই জ্ঞানই স্বর্গের ধারণার মূল। এই ধারণা সকল প্রশ্নের উর্দ্ধে। আজকের রাজনৈতিক কাণ্ডারীরা একই রকম। ‘আচ্ছে দিন’ এর সংজ্ঞা, ‘অমৃতকাল’ এর অর্থ বা ‘রামরাজ্যের’ ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তর আসে না। তার বদলে উঠে আছে একগাদা অভিযোগ, অনেকটাই স্বর্গ নিয়ে প্রশ্ন করলে পুরোহিতের উত্তরের মতো। সেখানে প্রশ্নের উত্তর আসে না, উল্টে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন আসে এবং সর্বোপরি অবিশ্বাসী বা নাস্তিক নামকরণ হয়।

 রাষ্ট্র পরিচালকরা কিছু দিন পর পর তাদের পরিচালিত ব্যবস্থাকে বিভিন্ন নাম দিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। আবার তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুচ্ছকেও একই ভাবে তারা নামকরণ করে থাকেন। ‘আচ্ছে দিন’, ‘অমৃতকাল’, ‘রামরাজ্য’ এগুলো সেরকমই নামকরণ। ‘রামরাজ্যে’র উল্লেখ সর্বাগ্রে এদেশের মানুষ মহাত্মা গান্ধীর কাছে পেয়েছিলেন। গান্ধী সুশাসনকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই সুশাসনের সংজ্ঞা তিনি দিয়ে যাননি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো বাস্তববাদী তিনি অবশ্য কোনোদিনই ছিলেন না। সেদিক থেকে বিচার করলে 'রামরাজ্য' নিয়ে তাঁর নিজের ধারণাই বা কতটুকু পরিষ্কার ছিল তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যায়। যাই হোক মহাত্মা গান্ধীর সেই রামরাজ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, সামাজিক অবস্থা কি রকম হবে তা নিয়ে আমাদের কিছুই জানা নেই। এমনকি যার থেকে এর সৃষ্টি সেই কাব্যগ্রন্থ রামায়ণে উল্লেখিত  রামচন্দ্রের রাজ্যই বা কিরকম পরিচালিত হতো তারও বিশদ বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সেদিক থেকে একান্তই ধর্মীয় আবেগ পরিচালিত এবং একই সঙ্গে চরম ধোঁয়াশাপূর্ণ। এদিকে স্বাধীনতা লাভের পর ৭৫-টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। শাসক দলের কাছে কিছুদিন পর পর ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার কথা শোনা যায়। সেটা স্বাভাবিক, নিজের ঢাক পেটাতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের অবস্থা কোথায়?  ৭৫-বছরে কতটুকু আমরা এগোতে পেরেছি। এই বছর বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিষয়ের ওপর তৈরি সুচিতে ভারতের অবস্থান নিম্নরূপ –



বিষয় সূচক

ভারতের অবস্থান

 উদ্বাবনী সূচক

৪০

পরিবেশরক্ষা সূচক

১৮০

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক

১৫০

গণতন্ত্র সূচক

৪৬

দুর্নীতি সূচক

85

স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচক

৬৬

উৎকোচ সূচক

৮২

খাদ্য সুরক্ষা সূচক

৭১

 অবসরকালীন ভাতা সূচক

৪০

ক্ষুধা সূচক

১০৭

যুব উন্নয়ন সূচক

১২২

শান্তি সূচক

১৩৫

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক

১২১

মানব স্বাধীনতা সূচক

১৩১

মানবসম্পদ সূচক

১১৬

অসাম্য সূচক

১৪৭

শিশু অধিকার সূচক

১১৭


দেশ যে এগোচ্ছে না এই কথা দেশের চরম শত্রুও বলতে পারবে না। ‘সাপ খেলানো মানুষের দেশ’ আজ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির অধিকারী। শিক্ষার হার, গড় আয়ু গত সাড়ে সাত দশকে অনেকটাই বেড়েছে। আজ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দুই জন ব্যক্তি এই দেশেরই মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশচর্চায় এদেশের উন্নতি রীতিমতো ঈর্ষনীয়। কিন্তু এই চোখ ধাঁধানো উন্নতির পেছনের অন্ধকারটা অত্যন্ত গাঢ়। এদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অভুক্ত, অশিক্ষিত মানুষ থাকেন। এদেশে স্কুল ড্রপ আউটের হিসাব আফ্রিকার দেশগুলোকেও পেছনে ফেলে দেয়। এদেশ আজও বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শিশুশ্রমিকের সংখ্যায় আমরা সবচেয়ে উপরে আছি। এখানে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও ধর্মীয় তাবেদারদের সৌজন্যেও আজ মাটির প্রতিমাতে প্রণাম করার জন্য রক্তমাংসের মানুষকে মরতে হয়। ধর্মীয় হানাহানির মধ্যে দিয়ে এদেশে রাজনীতি পরিচালিত হয়। যুবপ্রজন্মের জয়গান  এদেশে সারাদিন নেতাদের মুখে থাকলেও এদের অশিক্ষা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। এখানে ছেলেমেয়েদের হাতে শিল্পোৎপাদনের যন্ত্রপাতি তুলে দেওয়া না হলেও ধর্মের বা বর্ণের ধ্বজা কিন্তু সময় মতো দিয়ে দেওয়া হয়। শাসকদের স্বার্থরক্ষা বলে কথা। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই তালিকা দীর্ঘ,  সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রাপ্তির সোনালী থলিটা যেদিকে গেছে সেদিকে মানুষ জনসংখ্যার নিরিখে অত্যন্ত কম বললেও কম বলা হবে আর অপ্রাপ্তির শতছিদ্র থলিটা যেদিকে রয়েছে সেদিকে মানুষ গুণে শেষ করাটা অসহনীয় হবে। 

ইতিহাস বলে যুগ যুগ থেকে পুরোহিতবর্গ ও শাসনে থাকা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে ভয় আর লোভের অস্ত্রে পরাভূত করে রেখেছে। হাস্যকর হলেও সত্যিটা হল এই অলীক লোভ ও ভয় কাটিয়ে উঠে মানুষ খুব কম বারই এই অত্যাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পেরেছে। সাধারণত, সে ধর্মের মোড়কে বাঁধা এই কল্পনাকে কাঁধে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। দেশের বর্তমান শাসকরাও একই পথের পথিক হয়েছে। নিজেদের বিফলতা ঢাকতে কখনো দান তো কখনও শাস্তির অস্ত্র ব্যবহার করেন। এদিকে চলে নিজেদের কাজের রাতদিন প্রচার আর আগাম দিনের জন্য মানুষের মধ্যে স্বপ্নের ফুলঝুরি ছড়ানো। পরিশেষে পরিবেশিত হয় অতি পরিচিত কিন্তু মোক্ষম অস্ত্র-বিদ্বেষাস্ত্র। নির্বাচন আসলেই শোনা যায় - হিন্দুরা বিপদে আছে (হিন্দু খতরে মে হে)।  এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখলেই হিন্দুরা রক্ষা পাবে। বাস্তবটা হলো হিন্দুরা বিপদেই আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা আলাদা হলেও শ্রেণীগত দিক দিয়ে দেশের ৮০% মেহনতী জনগণের সমস্যাগুলো কিন্তু এক - বেকারত্বের জ্বালায় সকলেই জ্বলছে; চাহিদাও এক - নিরাপদ বর্তমান,  সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও শান্তি সমৃদ্ধিতে সবার বাঁচা চাই, যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান মৌলিক অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যেভাবে দেশে একের পর এক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, দেশের মানুষ প্রশ্ন ও যুক্তিহীন হচ্ছেন তাতে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ কিন্তু সর্বাবস্থাতেই – ‘খতরে মে হে’।

দশমীর দুপুরের অলস চিন্তা -
রাহুল রায়
Nov. 23, 2024 | সচেতনতা | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

লেখাটি লিখছি ৫ই অক্টোবর, এই বছর দিনটি বিজয়া দশমীর। শহরে বিশাল আয়োজনে ভাসান  চলছে। আরো পাঁচটি বাঙালি অধ্যুষিত জায়গার মতোই আসাম রাজ্যের এই শহরটিতেও দিনটি প্রতি বারের মতো এবারেও সাড়ম্বরে উদযাপন করা হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তার ছবি, আবেগস্ফীত বার্তায় ভরে উঠেছে। আর হবেই বা না কেন। মোটের ওপর ধর্মভীরু এই শহরের জনসংখ্যা তো আর কম নয়। আবার সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতির দিক থেকেও এই শহরের মানুষ পিছিয়ে নয়। এই শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব। প্রচলিত বিশ্বাস মতে ঘরের মেয়ে বছরের এই সময়ে ঘরে ফিরে আসে।  দশমীর দিনে সেই মেয়ে পতিগ্রহে পতিগৃহে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই দিনটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের বিশেষ আবেগ থাকে। চিরাচরিত এই আবেগের গণ্ডীর বাইরে গিয়ে ভাবলে দেখা যায় যে মাটির প্রতিমা তৈরি করে চারদিন সাড়ম্ভরে পুজো করে বিসর্জন, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই জ্ঞানের অভাবে গড়ে ওঠা প্রাচীন বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসকে তুষ্ট করার আয়োজন মাত্র। তবে লক্ষণীয় যে এই আয়োজনের সঙ্গে ‘ঘরের মেয়ে’, ‘গৃহ’, ‘শুভ শক্তি’র মতো  শব্দগুলো ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে।

এই তো গেল একটা দিক। এই দিকে 'ঘরের মেয়ে', 'ঘর', 'অশুভশক্তির ওপর শুভশক্তির জয়’ আছে। আছে আত্মীয়তার মাধুর্য। আছে বুকভরা আবেগ। এবার দেখা যাক  অন্য একটি দিকে। এই দিকটি আগেরটার মতো এক পক্ষের মাত্র ক’দিনের সাড়ম্বর স্থায়ীত্ব নিয়ে থাকে না। এর স্থায়ীত্ব কোনো অলৌকিক শক্তিকে কল্পনা করে নয়। এই স্থায়িত্ব বছরজুড়ে, এর উপস্থিতি অনাড়ম্বর সাধারণ মানুষের জীবনে, মননে। এদিকে আমরা দেখি  একদল লোভী মানুষ, তাদের অঙ্গুলহেলনে অঙ্গুলিহেলনে সরকার ও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের কর্তাদের সামনে ফি বছর মানুষের নিরুপায় অবস্থা। আমরা দেখি কিভাবে এদের পায়ে দলে দলে  মহিলারা পড়ে নিজেদের ঘর রক্ষার জন্য ভিক্ষা করে, কোলের শিশুকে এগিয়ে দিয়েও এই লোভীদের পথরোধ হয় না। না, এই দৃশ্য খুব বেশি দূরের নয়, সময় ও ভৌগোলিক,  কোনোদিকেই। আজ যে শহরে শারদীয় দুর্গোৎসব নিয়ে এতো জাঁকজমক,  তার থেকে মাইল পনেরোর দূরত্বের মধ্যেই আছে ডলু চা বাগান। সবুজে ঘেরা, হ্রদের ধারে পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলা ছবির মতো সুন্দর একটি বাগান। ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল এই বাগানের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। গত মে মাসে শ্রমিকদের প্রবল আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এই চা বাগানে রাজ্য সরকার বিমানবন্দর বানানোর নামে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল। যদিও কিছুদিন পরেই জানা যায় এই ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের কিছুই জানা ছিল না, অনুমোদন দেওয়া তো দূরের কথা। কথা হল সেদিন বিশাল পুলিশ বাহিনীর সামনে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাও নারী ছিলেন, এই বাগানটিই বংশপরম্পরায় এঁদের ঘর ছিল। কল্পকথার কৈলাশ পর্বত না হলেও কয়েক পুরুষ ধরে নিজেদের ঘাম, রক্তের বিনিময়ে তৈরী সেই ঘরের মাহাত্ম্যই বা কম কিসে।

আজকে ‘ঘরের মেয়ে’ ঘর শূন্য করে চলে যাচ্ছেন বলে যারা পাতার পর পাতা লিখছেন, সেদিন যে কেন অবাক নিস্তব্ধতায় তাঁরা এই রক্ত মাংসের মেয়েদের ঘরছাড়া করাকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরাই জানেন।

 শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোড়ে জোরে মাটির তৈরি প্রতিমা 'ঘরের মেয়ে'র স্থান পেয়ে যায় আর এই রক্তমাংসের মানুষগুলোর কপালে জোটে একরাশ বঞ্চনা ও অবহেলা।


এই পরিচিত্র কিন্তু শুধু এই শারদীয় দুর্গোৎসব বা দেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাসকারী মানুষের মধ্যেই সীমিত তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাট, কেরালা থেকে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, মানুষ ভিন্ন, আরাধ্য দেব-দেবী ভিন্ন কিন্তু কল্পকথার সেই আরাধ্য দেব-দেবীকে নিয়ে আবেগের যেমন শেষ হয় না, তেমনি রক্তমাংসের অসহায় মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনার প্রতি নির্বিকার, বীতস্পৃহ মনোভাবেরও বদল হয় না।   কোথাও বাঁধ, কোথাও মূর্তি, কোথাও খনি আবার কোথাও রেলপথের নামে এভাবেই শতসহস্র উমা, পার্বতীরা তাদের কৈলাশ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। পুজোর মণ্ডপে দেবী দুর্গার হাতে অসুরের মৃত্যু আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্য। পৌরাণিক কাহিনি মতে দেবী দুর্গা এখানে একাধারে নারীশক্তি ও শুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে অসুর অশুভশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। তবে ধর্মের ইতিহাস অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে। উজ্জ্বল বর্ণের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতা দুর্গা এখানে আক্রমণকারী, রণকৌশলী আর্য ও কৃষ্ণবর্ণের অসুর এখানে আদি ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আজকের সময়ের নিরিখে বিজয়া দশমীতে সেই পৌরাণিক কাহিনিকে পাথেয় করে 'অশুভশক্তির' ওপর 'শুভশক্তির' জয় উদযাপন করা হয়। অথচ তথাকথিত এই দেবীপক্ষ নিয়ে আমাদের বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে অনুষ্ঠানাদির বাইরে গিয়ে যদি দেখি, সেখানে কিন্তু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ধর্মীয় ইতিহাসের বারংবার পুনরাবৃত্তি।

সেখানে আজও ভূমিপুত্র, অনুন্নত, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষেরা সমাজে ক্ষমতাবানদের আগ্রাসন লোভের  কাছে এভাবেই পরাভুত হন।

 তাদের কথা শোনার, তাদের দুঃখ বোঝার ইচ্ছা কারোর নেই। জায়গা বদলায়, সময় বদলায়, দৃশ্য বদলায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে এই অবিচারের কি কোনো প্রতিবাদ হয় না?  সাধারণ মানুষ বা অন্ততঃপক্ষে যারা দিনের পর দিন ধরে এভাবে অত্যাচারীত হয়ে আসছেন তারা কেন প্রতিবাদ করেন না। দেশে থানা আছে, আদালত আছে।  প্রশ্নের উত্তরটা হল সমসাময়িক সভ্যতা থেকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকা এই মানুষদের প্রতিবাদের 'অস্ত্র' বা 'রণকৌশল' সবই সেকেলে। 

তাদের কাছে থানা, আদালত কোনো কিছুই বিচার,  ভরসা দিতে পারে না। সংবাদমাধ্যমের কাছে এরা খুব বেশি মাত্রায় অচ্ছুৎ।

 

যদিও বা কোনোদিন, কোনোভাবে এই প্রান্তিকরা একান্ত নিরুপায় হয়ে তাদের প্রতি হয়ে আসা এই অবিচারের প্রতিবাদ করেন তখন  তাদের অবস্থা হয় অসুরের মতোই। মরতে তো তাদের হয়ই, উপরন্তু সমাজের সামনে সভ্যতার নিখাদ শত্রুর পরিচয়ও পেতে হয়। সংবাদমাধ্যম যেমন তাদের রাতারাতি জঙ্গি বানিয়ে দেয়, সরকার মাওবাদী তকমা দিয়ে দেয়। ধর্মীয় ইতিহাসের ভূমিপুত্র সেই অসুর প্রচারের ঠেলায় পৌরাণিক কাহিনীর সভ্যতা বিরোধী, নারীর অপমানকারী অসুর হয়ে যায়। আর যারা চরম স্বার্থপরতার প্রমাণ দিয়ে এই চরম অমানবিক কাজটি করে এরাই হয়ে ওঠে সমাজের কাছে সভ্যতার ধ্বজা বহনকারী অগ্রদূত। জ্ঞান ও চেতনার অভাবে আমরা, সাধারণ মানুষ এই অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের ওপর তাদের এই জয়কেই সভ্যতার জয় বলে মেনে নিই, সাড়ম্বরে উদযাপন করে আত্মতুষ্টি লাভ করি। 

রাহুল রায়, শিলচর।

স্রোতের বিরুদ্ধে চলা বিস্মৃত এক বিশ্বমানব -
রাহুল রায়
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:977 | likes:0 | share: 0 | comments:0

হিন্দুরা সমুদ্র অতিক্রম করতে পারবে না। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের সৌজন্যে দীর্ঘদিন সমুদ্র ভ্রমণের ওপর সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কারন বা ইতিহাস কী সেটা তৎকালীন সমাজপতিরাই বলতে পারেন। কিন্তু এর ফলে শুধু হিন্দুরা নয়, সমগ্র মানবজাতিরই বিশাল ক্ষতি হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কথা বাদ দিলে সুদীর্ঘকাল ভারতের বিশাল অংশের মানুষ সামাজিক কারণে সমুদ্র পেরোতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসনে এদেশে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য জ্ঞানধারার বিস্তারের মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রতি সমুদ্রের অন্যদিকের সভ্যতার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। একদিকে যুগের পর যুগ থেকে চলে আসা সামাজিক শোষণ যেমন তাঁদের প্রচলিত নিয়ম নীতির প্রতি বিতৃষ্ণ ও নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল তেমনি দেশের শাসকদের চোখ ধাঁধানো উন্নতি তাঁদের মন-মস্তিষ্ককে বিশাল ভাবে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এই উন্নতির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভাবে জানতে, নিজেদের চোখে দেখতে জানতে সমুদ্র পেরোতে হতো। বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তার ক্ষমতাই বা আর কত। অন্তহীন, উচ্ছল জলরাশির সমুদ্রের দিকে তখন নব্যশিক্ষিতের দল আর সামাজিক ভ্রূকুটিকে মাথায় নিয়ে অসহায় ভাবে দেখার চেয়ে বর্হিবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হিসাবে উৎসাহ ভরা চোখে দেখতে শুরু করল। অবশেষে সামাজিক বন্ধন, দীর্ঘদিনের সব সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে একদিন একজন সমুদ্রের ওপারের অংশের দিকে এগিয়ে চলল। পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে, আত্মীয়তা করতে সে এগিয়ে চলেছিল, পেছনে পড়ে রয়েছিল একদল কুপমণ্ডুপ ও তাঁদের তৈরী চরম বিরক্তিকর কিছু নিয়ম নীতি। 

ব্রিস্টল, ব্রিটেনের একটি সুন্দর নগর। সেই নগরে গত ১৮৫ বছর ধরে প্রতিবছর একজন ভারতীয় মনীষীর স্মৃতিতে তৈরী মন্দিরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি সেখানে বাসরত প্রবাসী ভারতীয়রা করেন না। নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটি যথাযথ মর্যাদা সহকারে আয়োজন করা হয় এবং সেই শহরের মেয়র সহ গন্যমান্য ব্যক্তিরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ব্রিস্টল শহরে সেই মনীষীর নামে একটি রাস্তাও আছে। ১৯৩০ সনে এই মনীষী যখন ব্রিটেন এসে পৌঁছান তখন তাঁকে দেখতে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী ছাড়া ব্রিটেনে কোনো ভারতীয়র জন্য তা হয়নি। এমনকি ১৯৯৩ সনে আমেরিকার চিকাগো শহরে ধর্মসভার পর স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও সম্ভবতঃ সেরকম উন্মাদনা সৃষ্টি হয়নি। উল্লেখযোগ্য সেই ব্যক্তিই প্রথম ভারতীয় যিনি সমুদ্র পার করে বিদেশ গিয়েছিলেন। ১৮৩০ সনের ১৯ নভেম্বর, কলকাতা থেকে ‘ফবর্স’ জাহাজে চেপে তিনি ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। বাংলার নবজাগরণের জনক হিসাবে পরিচিত সেই মনীষী ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায়।

বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। রামমোহন রায় ব্রিটেনে কিন্তু গিয়েছিলেন বিজয়ী হয়েই। তাঁকে নিয়ে সেখানকার মানুষের উন্মাদনার শেষ ছিল না। সতীদাহ নিয়ে বিরোধীতা এদেশে নতুন নয়, তৃতীয় শিখ গুরু অমর দাস থেকে শুরু করে উনিশ শতকের গোঁড়ায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এই তালিকা কিন্তু খুব একটা ছোটো নয়। কিন্তু সতী দাহ প্রথাকে আইন করে বন্ধ করার পেছনে রামমোহনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। 


মহিলাদের এই সামাজিক কুপ্রথা থেকে মুক্ত করার জন্য ব্রিটেনের কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে রামমোহনের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কারণটা অনুধাবন করা দুষ্কর নয়।

 এই শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক কুপ্রথার থেকে এই মুক্তির সঙ্গে তাঁরা তাঁদের কাঙ্খিত মুক্তির মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। ১৮২০-২২ এর দিকে তখন ব্রিটেনে দেশে প্রচলিত দাসপ্রথা ও ভারতের সতীদাহ প্রথা বাতিল করার ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি সেদিন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে মারাত্মক রকম উৎসাহ দিয়েছিল। রামমোহন রায়ের ছবি ও সইয়ের তখন বিশাল কদর সর্বত্র। দোকানে দোকানে সেই ছবি ও সই লাগিয়ে রাখা হতো। তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজের অভিজাতরা দূর থাকতে পারেননি। ডিউক অফ সাসেক্স রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর একটি ছবি লাইব্রেরীতে লাগিয়ে রেখেছিলেন। পত্রিকার স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর আপোষহীন ভূমিকা দেশের বাইরেও তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে ১৮২৩ সনে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষ থেকে ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর শাসকদের এই হস্তক্ষেপ রামমোহন রায় মেনে নিতে পারেননি। তীব্র প্রতিবাদ করে ইংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে তিনি একটি ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। পরবর্তীতে সরকার তাঁর আবেদনে সাড়া না দিলে প্রতিবাদে তিনি তাঁর ফার্সী পত্রিকা ‘মিরাত-উল-আখবার’ বন্ধ করে দেন। সমসাময়িক যুগে ইংল্যাণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে এই ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও প্রেরণাদায়ক। ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলোতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে তাই সেই ভূমিকার কথা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। 

জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্বমানবতার তর্ক নতুন নয়। একদলের যুক্তি যেখানে আগে ঘর তো পরে পর, অন্যদলের যুক্তি সেখানে পাশের ঘরে আগুন লাগলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিজের ঘরও বেশিসময় বাঁচানো যায় না। রামমোহন রায় দ্বিতীয় দলের লোক ছিলেন।  কখনোই নিজেকে জাতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাননি। অস্ট্রিয় সেনারা পরাধীনতা বরণ করতে বাধ্য হলে ব্যথিত রামমোহন রায় সাংবাদিক বন্ধু বাকিংহামকে জানান যে ‘I am afraid I must be under the necessity of denying myself the pleasure of your society this evening; more specially as my mind depressed by the late news from Europe. I consider the cause of Neapolitans as my own and their enemies as ours. Enemies to liberty and friends of despotism have never been and never will be ultimately successful’। আবার স্পেনের স্বেচ্ছাচার থেকে দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর মুক্তি তাঁকে উৎফুল্ল করে তুলেছিল। সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে ইউরোপীয় বন্ধুদের নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডে নির্বাচনে শ্রমিক দলের জয়লাভ বা ফ্রান্সে উদারপন্থীরা ক্ষমতা দখল তাঁকে উৎসাহী করে তুলতো। বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স নিয়ে তাঁর অনুভূতি সবসময় ছিল বিশেষ। ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্স যেতে উদ্যোগীও হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা, উদারবাদের দেশ ফ্রান্সে যেতে পাসপোর্ট লাগে শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি কোনোমতেই স্বাধীনতার সেই দেশে কারোর অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবেন না। ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে চিঠি লিখলেন ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রীকে, ‘All mankind are one great family of which numerous nations and tribes existing are only various branches’। চিঠি পৌঁছায় ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের কাছে। রাজা সাদরের আমন্ত্রণ জানান আরেক রাজাকে। সেই ঘটনার সাত বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৪ সন থেকেই রামমোহন রায় সেই দেশের এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ফ্রান্সবাসীরা রামমোহন রায়কে সাদরে গ্রহণ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইউরোপের এই সুসভ্য দেশটির সঙ্গে রামমোহন রায়ের সুমধুর আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। ইউরোপে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেই সময়ে স্পেনের নতুন প্রণীত সংবিধানটি রামমোহন রায়কে উৎসর্গ করা হয়। 

   এই বছর রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের ২৫০ বছর পালন করা হচ্ছে। বলতে বাধা নেই রামমোহন রায়কে ভারতীয় নবজাগরণের জনক বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। নিজের সময়ের তুলনায়  শতাধিক বছর আধুনিক চিন্তার এই মানুষটি একটি আধুনিক ভারতীয় তথা মানব সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। অবিচার, অনাচার, অত্যাচার মুক্ত একটি সমাজ। 


ধর্মীয় অনাচার সহ্য করতে না পেরে পৃথক ধর্মের চিন্তা করলেন, জন্ম হয় ‘ব্রাহ্মসমাজের’, সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে নেমেছিলেন।


 ভবিষ্যত সমাজের উদারীকরণে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনীকরণের গুরুত্ব বুঝতে পেরে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ্চাত্য শিক্ষার আমদানীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আধুনিক যুগে অনেকের কাছেই তাঁর ব্রিটিশের সাহচর্য দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সেই জায়গা থেকে ধারণা তৈরী করার আগে সেই সময়টাকে ভাবতে হবে। এবং পাশাপাশি মনে রাখতে হবে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রামমোহন রায় ব্রিটিশের তৈরী নীতির প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিলেন। সেই মানুষটিও আজ আমাদের সমাজে প্রায় বিস্মৃত। কেন্দ্র বা তাঁর জন্মভূমি পশ্চিমবাংলা সহ কোনো রাজ্য সরকারই তাঁর জন্মের ২৫০-তম বর্ষ পালনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে করার কারণও নেই। আজকে যারা ধর্মের নামে, জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে রাজনীতি করে তাঁদের কাছে রামমোহন রায়ের মতো মনীষীদের যে গুরুত্ব থাকবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। এই মানুষটি যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই সমাজে এরকম রাজনীতি যে খুবই অচল। তারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার্থে সমাজকে রামমোহন রায়ের প্রদর্শিত পথের ঠিক বিপরীতে নিয়ে যেতে চায়। এবার মানুষ তথা সমাজকেই ঠিক করতে হবে যে তাঁরা কোন পথের পথিক হবেন।


রাহুল রায়

স্বামীজী রোড, শিলচর

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929